দুই দেশের নতুন এই সম্পর্কের মাত্রা এশিয়ায় কেবল চীন ও ইরানকেই সুবিধা দেবে না, শক্তিশালী করবে পাকিস্তানকেও।
এ বছরের জুলাই মাসের শুরুর দিকে বেইজিং এর সঙ্গে এক দীর্ঘ মেয়াদী ও কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তির কথা জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, আফগান সীমান্তের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ রেল প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিয়েছে ইরান।
ইরানের সঙ্গে চীনের নতুন এই কৌশলগত সম্পর্ক এবং চীনের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতকে প্রকল্প থেকে বাদ দেয়ার ব্যাপারটি একই সময়ে খবরের শিরোনাম হলেও তা মূলত সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং হিমালয়ের কোল ঘেঁষা সীমান্ত নিয়ে ভারত-চীন দ্বন্দ্বের মধ্যেই এসব খবর এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির জন্য এক নতুন বার্তা। এটা খুবই স্পষ্ট, ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতিই দেশটিকে চীনের এতো কাছাকাছি এনেছে এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
গেল ১১ জুলাই মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেইজিং ও তেহরানের মধ্যে চূড়ান্ত না হওয়া সেই চুক্তি অনুযায়ী, ইরানের ব্যাংক, পরিবহনসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে চীন। বিনিময়ে আগামী ২৫ বছর ইরান থেকে স্বল্প মূল্য ও বিশেষ সুবিধায় জ্বালানী তেল নেবে চীন। আর এই চুক্তিকে মনে করা হচ্ছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর নেয়া উচ্চাভিলাষী বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ –বিআরআই এর একটি অংশ হিসেবে। এর ফলে ইউরেশিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাবে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব।
চীন-ইরান চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশের পর গেল ১৪ জুলাই ভারতীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের বন্দর শহর চাহাবার থেকে আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী শহর জেহাদান পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিতে যাচ্ছে তেহরান। ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইরকনের এই প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবা দেয়ার কথা ছিলো। ‘দ্য হিন্দু’ জানিয়েছে, সব মিলিয়ে এখানে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের কথা ছিলো প্রতিষ্ঠানটির।
তবে ভারতীয় পত্রিকার এই প্রতিবেদনকে খুবই কৌশলে এড়িয়ে গেছে ইরান। তেহরান জানিয়েছে, জেহাদান-চাহবার রেললাইন প্রকল্পের সাথে ভারত রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক নেই এবং ভারতকে বাদ দেয়ারও কেছু নেই। তবে তেহরানের এমন অস্বীকার সত্বেও অনেকেই নানাভাবে এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তানে অবস্থিত চীন পরিচালিত গোয়াদার বন্দরকে এড়িয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যে বিকল্প বাণিজ্য পথ খোলার পরিকল্পনা করেছিলো ভারত, ইরানের এই রেল প্রকল্প থেকে ছিটকে পড়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
মুম্বাই থেকে মস্কো পর্যন্ত বিস্তৃত ৭ হাজার ২’শ কিলোমিটার সমূদ্র পথ বা ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর এর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই চাহাবার। ইউরেশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বহু বছর ধরে এই রেল প্রকল্পের ব্যাপারে ইরানকে উৎসাহ দিয়ে আসছিলো ভারত। এর পেছনের কারণ হলো, ভারতের বিশ্বাস ছিলো এর মাধ্যমে ইরানকে চীনের রোড অ্যান্ড বেল ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই থেকে দূরে রাখা যাবে। একই সঙ্গে ভারতের ধারনা ছিলো, পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোন ধরনের সম্পর্ক উন্নয়ন থেকে ইরানকে সরিয়ে রাখা যাবে।
গেল ২০ বছর ধরে প্রত্যাশিত এই নতুন বাণিজ্য পথের ব্যাপারে ইরানও ভারতের আশা জাগিয়ে রেখেছে, এই উদ্যোগ এগিয়ে নিতে নানা ধরনের সহযোগিতা করেছে। তবে গেল বছর হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিনীদের সামরিক অংশীদার ও ইরানের প্রবল বিরোধী শক্তি ইসরাইলকে খুশি করতে ইরান থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয় ভারত। এর পরই ভারতের প্রতি তেহরানের আচরণেও পরিবর্তন আসে। এদিকে আরেক খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু আরব দেশের সমন্বয়ে ও ইজরাইলী নেতৃত্বাধীন ট্রান্স-অ্যারাবিয়ান করিডোর বা ট্যাপে যুক্ত হতে যাচ্ছে ভারত। এই খবর এ অঞ্চলে ইরানকে নতুন সহযোগী খুঁজতে বাধ্য করে। এর ধারাবাহিকতায় এটা স্পষ্টতই বলা যায়, চীনের সঙ্গে ইরানের গাটছড়া বাধা ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ারই প্রমাণ। ইরান-চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের এ ফলাফল নিশ্চিতভাবে ভারতের জন্য নেতিবাচক হবেই।
বেইজিং ও তেহরানের নতুন সমঝোতা অনুযায়ী, ইরানের বেশ কিছু বন্দরের উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে চীন। এর মধ্যে অন্যতম কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীর পূব দিকে অবস্থিত বন্দর-ই-জাস্ক। এটি এতোই তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই পদক্ষেপের ফলে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ৭টি সমূদ্র রুটের নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে চীন। এর ফলে বাহরাইনের ঘাঁটি থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নজর রাখা মার্কিন নৌবাহিনীর সপ্তম নৌবহরের প্রাধান্য খর্ব হবে। পাশাপাশি, পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর, জিবুতির বন্দর এবং সাথে যুক্ত হওয়া ইরানের বন্দর-ই-জাস্ক, এই তিন বন্দর থেকে পুরো ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি নতুন মাত্রা পাবে। আর সব কিছু মিলিয়ে এটি হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে করে চীনের বিরুদ্ধে ভারত যে তৎপরতা চালাচ্ছিলো তাতে পানি ঢেলে দেয়ার সামিল।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ –বিআরআই এ ইরানের অন্তর্ভুক্তির ফলে অঘোষিতভাবেই আফগানিস্তানে প্রভাব হারাচ্ছে ভারত। ৯/১১’র পর আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন বাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের শুরু। তবে গেল ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে যে সমঝোতা হয় তাতে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব এমনিতেই এক ঝাঁকুনি খায়। মার্কিন-তালেবান সমঝোতায় এমনিকেই ভারতের কোন অংশগ্রহণ ছিলো না। তার মধ্যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রক্রিয়ায়ও ভারত কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখন শুধু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের অপেক্ষা। এর পর আফগানিস্তানে ভারতের আর কোন প্রভাবই মূলত থাকবে না।
ওয়াশিংটনের উৎসাহ থাকলেও নয়াদিল্লি মূলত তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনায় নিজেকে নিস্প্রভ রেখেছে। অন্যদিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের মাটিতে নিজেদের বিনিয়োগ ও স্বার্থ সংরক্ষণ করার অংশ হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরেই সরকার ও তালেবান উভয় পক্ষের সঙ্গেই নিবিড় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে আফগানিস্তানে মার্কিন যুগের অবসানের পর কাবুলকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অন্তর্ভুক্ত করার দোড় গোড়ায় পৌছে গেছে বেইজিং। ইরানের সঙ্গে চীনের এই সম্পর্ক তাদের স্বার্থ সিদ্ধির ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এশিয়ায় এই সম্পর্কের মাত্রা শুধু চীনকে সুবিধা দেবে তাই নয়, সুবিধাভোগী হবে পাকিস্তানও। প্রথমত, চীনের সঙ্গে ইরানের মাখামাখি রকমের এই সম্পর্ক পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান শত্রু ভারতকে দুর্বল করে দেবে। এতে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক চাল ও নিরাপত্তার হুমকির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কৌশলগতভাবে পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখবে। দ্বিতীয়ত, বিআরআই’তে ইরানের পুরো মাত্রায় অংশগ্রহণ করার পর তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ইসলামাবাদকে পুরো সহযোগিতা দিতে পারবে বেইজিং। এতে বেলুচিস্তানে যে জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদের উত্থান ঘটেছে তা দমতে দুই দেশই সহযোগিতা পাবে। তৃতীয়ত, ইরানে চীনের অবস্থান মানেই চাহাবার বন্দরের সঙ্গে চীন পরিচালিত পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের আর কোন প্রতিযোগিতাই থাকবে না। এবং সবশেষ বলা যায়, ইরান থেকে ভারতের গুটিয়ে আসা মানে, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় সব ব্যবসা ও পণ্য পরিবহন পরিচালিত হবে পাকিস্তানের বন্দর ব্যবহার করে।
তবে, এসব সুবিধা পেতে হলে পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এসব পদক্ষেপ নতুন হলেও পাকিস্তানকে ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিশেষ সুবিধা দেবে, এটা নিশ্চিত।
লেখক: আব্দুল বাসিত, সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ –আরএসআইএস এর রিসার্চ ফেলো।
আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন সাজিদ রাজু।
Discussion about this post