সমাজে যৌতুক হলো একটি কঠিন সামাজিক রোগ। আমাদের সমাজে গরীব-ধনী সব পরিবারেই যৌতুক প্রথা বিদ্যমান। যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই স্ত্রীরা স্বামীদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, কখনো কখনো মারাও যাচ্ছে। একাধিক সন্তানসহ নারীকে প্রায়ঃশই ঘর সংসার হারাতে হয় যৌতুকের কারণে। বাংলাদেশে হত্যাকান্ডের শিকার নারীর বিরাট অংশই যৌতুকের বলি। আমাদের প্রচলিত আইন যৌতুক প্রথা সমর্থন করে না। আইনে যৌতুক দেয়া ও নেয়া উভয়ই অপরাধ। ইসলাম ধর্মে বিয়ে বন্ধনকে অত্যন্ত উঁচু আসন এ অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই শান্তিপূর্ণ বিয়ে বন্ধনের মাঝে অস্বস্তিকর যে ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজ শক্তভাবে আসন গেড়েছে- তা’হলো বিয়ে ব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা। যৌতুক প্রথা এদেশের জাতীয় জীবনে একটি নির্মম এবং কলঙ্কজনক অভিশাপ। এর জন্য দুঃখজনক পরিণতি নেমে আসে অগনিত নারীর জীবনে। জাতি হিসেবে অমর্যদাকর হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়, লাঞ্ছিত হয় মানবতা। বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে বরপক্ষ কন্যাপক্ষের নিকট থেকে যে টাকা, অলংকার, গৃহসজ্জা এবং বিনোদনমূলক সামগ্রী গ্রহণ করে থাকে। তাকে বলে যৌতুক। ধনী পরিবারগুলোতে বাড়ি-গাড়িও আদান-প্রদান হয়ে থাকে। ধনীদের বেলায় এটা বিলাসিতা, কিন্তু দরিদ্রের জন্য এটা অভিশাপ। একে নারী নির্যাতন প্রথাও বলা যেতে পারে। সামর্থ থাক বা না থাক, মেয়ে বিয়ে দিতে হলে যৌতুক দিতেই হবে এমনটাই যেন প্রচলিত নিয়ম। এটা আমাদের সমাজের একটা বিষাক্ত ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এ ব্যাধির শিকার নারী সমাজ ও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা। যৌতুক ব্যাধির যুপকাষ্ঠে কত সরল-সহজ নারী যে নিগৃহীত হচ্ছে তার হিসাব মেলানো মুশকিল। যৌতুকের পরিমান সন্তোষজনক বা মনমত না হলেই অনেক নিরপরাধ বধূকে অসহ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পরিত্যাক্ত হতে হয়। এমনকি জীবন বিসর্জনও দিতে হয়। যে গৃহবধূর স্বামীর সংসারে সোহাগ, স্নেহ ও ভালোবাসা পাবার কথা সে যৌতুকের কারণে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, তিরস্কারসহ শত শত নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে উঠে। যৌতুক ছাড়া মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না। এটা কেমন কথা? অনেক ভাল পরিবার,ভালো মানুষকে ও আমি যৌতুক চাইতে দেখেছি। যৌতুক ছাড়া বিয়ে হবে না আমি সম্প্রতি তা ও দেখেছি। যেখানে মেয়ের মা,বাবা যৌতুক দিতে রাজি সেখানে কারো কিছু করার থাকে না। অবাক হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। আবার অনেকে বধূকে বলে যৌতুক চাই নি তো কি হয়েছে তোমার মা,বাবা কেন দিল না? যাদের সামর্থ আছে তাদের কথা আলাদা বলেই মনে করি। মা,বাবার সামর্থ থাকলে মেয়েকে সংসার সাজিয়ে দেন। এটা সেটা উপহার দেন। আজকাল বিয়ের পর গুটিকয়েক মেয়েরাও টাকা,গাড়ি,ফ্লাট চাইতে ও দ্বিধা করে না। মেয়ের ভাষ্যমতে,আমারও অধিকার আছে। হক আছে। ন্যায্য কথা। কিন্তু মা,বাবা বেঁচে থাকতে কেন বলবে এটা দাও,সেটা দাও। আবার ধনী পরিবার বা স্বচ্ছল পরিবার মেয়েকে আগে থেকেই দিয়ে দেয়। সমস্যা হলো গরীব পরিবার গুলোর। তাদের কাছ থেকে জোর করে যৌতুক আদায় করা হয়। প্রথম আলোর সূএমতে,বরসহ চারজন গিয়েছিলেন কনে দেখতে। কনে তাঁদের পছন্দ হয়নি। তবে যৌতুক দিলে বিয়ে হতে পারে বলে আশ্বাস দেন। এমন কথায় চটে যায় কনেপক্ষ। তাঁরা বরসহ চারজনকে পেটান এবং মাথা মুড়িয়ে ঘরে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ঘটনাটি রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর বানিয়াপাড়া গ্রামের। বেশ কয়েকদিন আগে বুধবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত ২১ ঘণ্টা কনের বাড়িতে বরসহ ওই চারজনকে আটকে রাখা হয়। এই খবরটা পড়তে মজা লেগেছিল। সত্যি বলছি। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় যৌতুকের টাকা না দেওয়ায় শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে এক গৃহবধূ খুনের অভিযোগ উঠেছে। এই রকম লাখ ঘটনা রয়েছে। বিয়ের ভোজ শেষে মেয়েকে বরের হাতে তুলে দেওয়ার সময় যৌতুক দাবি করায় তখনই বরকে তালাক দিয়েছেন। এই রকম সাহসী সবাই হয় না। স্যালুট জানাই এই নারীকে। যৌতুক দেয়া,নেয়া চলছে। কখন ও এইরকম হবে কি জোরপূর্বক কিছু নেয়া মানুষ অন্যায় মনে করবে? যৌতুক দেয়া,নেয়া কি চলবেই?? যৌতুক প্রথা নিরসনের জন্য বাংলাদেশে যৌতুক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়েছে। এ আইনে যৌতুক প্রদানকারী এবং যৌতুক গ্রহণকারী, উভয়কেই শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যৌতুক বন্ধ হয়নি। অভিশপ্ত নারী সমাজ যৌতুক থেকে নিস্কৃতি পায়নি। যৌতুক প্রথা দূর করার জন্য আমাদের সকলকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করতে হবে, বিশেষ করে নারী সমাজকে। অর্থনৈতিক অক্ষমতা যৌতুক প্রথার একটি প্রধান কারণ। আমাদের দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি যৌতুক প্রথার প্রসারে সাহায্য করছে। যদি নৈতিকতা ও মানসিকতার স্ফুরন ঘটে এবং তরুণ সম্প্রদায়ের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে, তবে যৌতুক দূর হতে পারে। যৌতুক প্রথার কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের যুব ও শিক্ষিত সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যৌতুকের কারণে কোন নারী নির্যাতিত হলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনগত সহায়তা উপ-পরিষদ তাদেরকে আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে থাকেঃ
অভিযোগ পাওয়া মাত্র বাদীনি/বিবাদীর নাম, ঠিকানা ও অভিযোগ এর বিবরণী সহ একটি ফর্মে অভিযোগ গ্রহণ। উক্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে তদন্ত করা হয়। বিবাদীকে অভিযোগের বিবরণী উল্লেখ করে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য অন্ততঃ পক্ষে ১/২ সপ্তাহ সময় দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। বিবাদীপক্ষ তাদের বক্তব্য মহিলা পরিষদের আইন সহায়তা কমিটির কাছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রদান না করলে তাদের কাছে তারপর আরো ২টি চিঠি পাঠানো হয়। বিবাদীপক্ষ তাদের বক্তব্য পেশ করলে উভয় পক্ষের বক্তব্য তাদের পরস্পরের উপস্থিতিতে শুনানীর জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। উক্ত নির্ধারিত তারিখে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সালিসীর মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। সালিসের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসায় ব্যর্থ হলে বাদীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয় এবং তাদেরকে প্রয়োজনে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়। ইসলামে যৌতূকের সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও ব্যাপকভাবে যৌতুকের বিস্তার ঘটে চলছে। এই যৌতুক প্রথা মুসলমানদেরও কোনো সংস্কৃতি নয়। অথচ মুসলমান পরিচয়ের বহু মানুষ যৌতুক নামের ইসলামবিরোধী এই সংস্কৃতি লালন করছে। মুসলমানেরা কুরআন-হাদিসের শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে এ ধরনের প্রথার বিস্তার ঘটেছে। যারা যৌতুক নিচ্ছে, তারা সবাই যে মূর্খ তা-ও নয়। বেশির ভাগই কম-বেশি লেখাপড়া জানেন। এসব যৌতুকলোভী ব্যক্তি অবশ্যই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন। হয়তো সবাই উচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করতে পারেননি। আবার উচ্চ ডিগ্রিসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যেও যৌতুক গ্রহণের খবর পাওয়া যায়, তবে সবাই নয়। তারা ছাত্রজীবনের ক্লাসগুলোতে যৌতুক নেয়া একটি জঘন্য অপরাধ, সে সম্পর্কে কি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন? অবশ্যই সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ শিক্ষাব্যবস্তায় যৌতুকের কুফল সম্পর্কে তেমন উপযুক্ত পাঠের ব্যবস্তা নেই। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা সেই ব্যবস্তা রাখেননি। যৌতুকের কুফল সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান নিতে হলে কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্তায় কুরআন হাদিসকে দূরে রাখা হয়েছে ।কুরআন হাদিসেই নারীর মর্যাদা সম্পর্কে পূর্ণ শিক্ষার ব্যবস্তা আছে। রাসূল সা: আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় নারীকে গর্ত থেকে তুলে রানীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামী বিধানে পুরুষ নারীকে বিয়ে করলে তাকে (পুরুষকে) মোহরানা আদায় করতে হয়। সেখানে যৌতুক নামের কোনো বিষয়ের স্তান নেই, লাখ লাখ মাদরাসা শিক্ষার্থী উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বড় বড় আলেম হচ্ছেন। তারা কি যৌতুকের কুফল সম্পর্কে সমাজের (কুরআন-হাদিসের শিক্ষা পায়নি) এমন লোকদের সচেতন করতে সক্ষম হয়েছেন? তারাও সক্ষম হননি এ ব্যাধি সম্পর্কে সাধারণকে সচেতন করতে। পরকালে মহান আল্লাহ এসব আলেমকে ছাড়বেন না। তবে অনেক বিচক্ষণ আলেম সমাজের কিছু লোককে সচেতন করতে সক্ষম হচ্ছেন। তাদের মতো অন্য আলেমদেরও এ ব্যাপারে কাজ করা দরকার। কিছু প্রগতিবাদী নারী নেত্রী নারীদের সমান অধিকারের নামে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কার্যকলাপ দিয়ে নারীদের প্রভাবিত করছেন। যার ফলে নারীরা আরো বেশি অধিকারহীন হচ্ছেন। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহই নারীদের উপযুক্ত অধিকার দান করেছেন। এর চেয়ে বেশি অধিকার কেউ দিতে পারে না। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন ;= আর তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) কষ্ট দেয়ার জন্য আটকিয়ে রেখো না, এতে তোমাদের বাড়াবাড়ি করা হবে। যে এরূপ করবে সে নিজের ওপরই জুলুম করবে । (বাকারা-২৩১) আমাদের দেশে তিন লাখেরও অধিক মসজিদ আছে। এই মসজিদের সম্মানিত ইমামরা যদি নিয়মিত যৌতুকের কুফল সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের বাণী থেকে মুসল্লিদের প্রশিক্ষণ দেন, তাহলে দেশ থেকে যৌতুক নামের ব্যাধি পালিয়ে যাবে। ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম, সেখানে নারীর কাছ থেকে যৌতুক আদায় করার প্রশ্নই আসে না।আসুন আমরা সকলই যৌতুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই,বদলাতে চেষ্টা করি ঘুণে ধরা এই ঘৃণ্য বর্বরোচিত রীতিকে।
Discussion about this post