গোটা বিশ্বে করোনার অভূতপূর্ব আক্রমণ মানব জাতির জন্য কি কোনো বার্তা বহন করে, না শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এর অবসান ঘটিয়ে কি মানব জীবন আবার প্রাক করোনার ছন্দে ফিরে যাবে? ইতিহাসে অতীতের মহামারীর মতোই শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লিখিত থাকবে। করোনার মতোই বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন আগের মতোই সমানতালে চলবে। ভবিষ্যৎ পরিণাম যাচাই এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার নিশ্চিত না করে পুঁজি ও বস্তুবাদী মুনাফা তাড়িত সমাজ ব্যবস্থার যাঁতাকলে পড়ে প্রকৃতি তার মনোরম ও জীবন ধারণকারী গুণাবলি হারাতে থাকবে। আজকের দিনের আরাম-আয়েশ বিলাসিতা ভোগ করতে গিয়ে আগামী দিনের জীবন ধারণ অসহনীয় করে তুলবে।
মনে আশা জেগেছিল বিশ্বব্যাপী প্রকৃতির এই ধাক্কায় আমরা জেগে উঠে মন থেকে হারিয়ে যাওয়া আল্লাহ্, বিবেক ও মানবিকতা কিছুটা হলেও ফিরে পাব। বিপন্ন পৃথিবীকে বিপদমুক্ত করে সুখ, শান্তি ও সুষমের মানব সমাজ গড়ায় মন দেব। হায়! আমার আশায় ছাই ঢেলে দিয়ে করোনাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি ও অমানবিকতা আরো নতুন আকারে বিস্তার লাভ করছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও শান্তির সুবাতাস না বয়ে দিন দিন তা আরো উত্তপ্ত হচ্ছে, যুদ্ধের হুমকি-ধমকি আরো বাড়ছে।
করোনার বার্তা ছিল মানব ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ এখন এক সূত্রে গাঁথা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখন কোনো একটা দেশের, কোনো একটা এলাকার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমনটি ছিল অতীতে। সুদূর অস্ট্রেলিয়া ও আমাজনের আগুনে ক্ষতি হয়েছে সম্পূর্ণ পৃথিবীর। প্রযুক্তি বা কারিগরি জ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে পাওয়া পারমাণবিক বোমা, রকেট, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদির সংযোজনে দাম্ভিক মানুষ আর সবকিছু ভুলে শুধু এই নিয়েই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চাঁদে ভ্রমণ, মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপন, মানুষের বিকল্প রোবট তৈরি, আরো কত কি আমাদের এজেন্ডায়।
অথচ অদৃশ্য অতি ছোট একটি এক বীজাণুর আঘাতে আমাদের জীবনধারা তছনছ হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত ৮ লাখ লোক প্রাণ হারাল, অর্থনীতিতে ধস নামল। এত কিছু অর্জন ও সাফল্যের পরও প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায় হতে পারে তা প্রমাণিত হলো। দুঃখের বিষয় আমাদের জীবন ধারা, অর্থনীতি ও জীবন দর্শন প্রকৃতি বিরোধী। যে প্রকৃতি বেঁচে থেকে সুস্থ, সচ্ছল ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য আমাদের সব উপকরণ যোগায় তা অতি লোভ, অতি লালসা, অতি চাওয়া-পাওয়ার ভারে এখন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিনে দিনে বাড়ছে, মানবজাতি অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। আমাদের রাশি রাশি রকমারি যন্ত্রদানব থেকে নির্গত কার্বন বিশ্বের উষ্ণতা বাড়িয়ে বেঁচে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে। আমরা জেনে শুনেই সেই পথে হাটা দিচ্ছি মুনাফা তাড়িত জীবন ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাণী জগতেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বীজাণুর জীনে মিউটেশন ঘটে নতুন স্ট্রেইন বা রূপে আরো ক্ষতিকর হয়ে তা দেখা দিতে পারে
করোনার জন্ম কাহিনী নিয়ে নানা তথ্য দেয়া হচ্ছে। আমার ভয় ও ভাবনার সমর্থনে ১৮ আগস্ট, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক কালের কণ্ঠের এক সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেখানে বলা হয়েছে- ‘বারবার চরিত্র বদল করছে নভেল করোনা ভাইরাস। শুধু তা-ই নয়, বিবর্তনও হচ্ছে এই ভাইরাসের। আর তাতেই সমস্যায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় নভেল করোনা ভাইরাসের নতুন একটি প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেছে। এই প্রজাতি সাধারণ করোনা ভাইরাসের তুলনায় ১০ গুণ বেশি সংক্রামক- এমনটাই দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।
মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মহাপরিচালক নুর হিশাম আবদুল্লাহ বলেছেন, এই নতুন প্রজাতির খোঁজ মেলার অর্থ হলো এতদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে যে গবেষণা হলো তা ফের নতুনভাবে শুরু করতে হবে।’ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বিভিন্ন দেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম হচ্ছেন কে কার আগে সফল হয়ে পৃথিবীতে নেতৃত্ব ফলাবেন। অথচ প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমম্বয়ের মাধ্যমে গবেষণা, আবিষ্কার ও বিতরণে মনোযোগী হওয়া। শীর্ষ প্রযুক্তিবিদ বিলগেটস বলেছেন করোনা-ই শেষ কথা নয়, আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে আগামীতে যদি আমরা ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসারণ রোধ করতে না পারি। এক হিসাবে বলতে গেলে করোনা কার্বনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর অন্যতম সেরা পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এক বক্তব্যে বলেছিলেন, এক সময়ে মানুষের উদ্ভাবিত রোবটের কারণে মানব অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
ইদানীং এক খবরে দেখলাম আমেরিকার তৈরী রোবট ৫ বছরের মধ্যে মানুষের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হবে। তাহলে তো আগামীতে পৃথিবীর কর্তৃত্ব রোবটের কাছেই চলে যাবে। দৈব দৃষ্টিতে দেখতে গেলে নানাবিধ পাপাচারের বীজাণুতে আক্রান্ত আজকের মানব সমাজে নৈতিকতাবোধ জাগাবার জন্য নতুন কোন নবী বা ধর্মীয় নেতার আগমন ঘটবে না।
আমরা জানি, হযরত মুহম্মদ (স) শেষ নবী। আমরা নিজ নিজ প্রচেষ্টায় এই সংক্রামণ থেকে মুক্ত হতে হবে মানসপটে আমূল পরিবর্তন এনে। অন্যথা ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ্ তায়ালা কোরআন শরীফে বলেছেন, যখন কোন জাতির মধ্যে পাপাচার সীমা অতিক্রম করে যায় তখন তিনি সেই জনপদ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে। যেমন খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভুমিকম্প, মহামারী ইত্যাদি। আমরা ধরে নিতে পারি করোনা আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে মানবজাতিকে সাজা ও সতর্কীকরণের জন্য। যতকিছুই চেষ্টা করি না কেন করোনা মুক্ত হওয়ার জন্য, মন থেকে সৃষ্টি বিরোধী পাপের বিজাণু বিতাড়িত করতে না পারলে আর সব চেষ্টাই বিফল হবে। এক বীজাণুর আক্রমণ থেকে ম্ক্তু হলেও নতুন বীজাণুর উৎপত্তি ঘটবে।
কুরআনে প্রদত্ত আল্লাহর কথা অনুযায়ী তিনি সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যে ভরা, নয়ন জুড়ানো ও হৃদয়গ্রাহী প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির সেবার জন্য। আমাদের বৈরী ক্রিয়াকাণ্ডের কারণে সেই প্রকৃতি এখন আমাদের শত্রু। মানুষের চাহিদার শেষ নেই তাই পৃথিবীতে এত বিপত্তি। ক্ষমতা ও অর্থলিপসায় মোহগ্রস্ত কিছু মানুষ গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলছে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ আমার অন্তিম জীবনে দেখে যাওয়ার আশা করি না, তবে যদি অলৌকিকভাবে কিছু ঘটে সেই আশা ত্যাগ করি না।
মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র নেতৃত্বদানকারী যোদ্বা কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে একমত হয়ে বলি, করোনার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় আমরা যেনো এক হয়ে একদিন জাতীয়ভাবে আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের কাছে ফরিয়াদ করি করোনা মুক্ত হওয়ার জন্য। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই তিনি যেন সরকারি পর্যায়ে এক দোয়া প্রার্থনা উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেন। স্রষ্টাময় মহাবিশ্ব ও পৃথিবীতে বাস করে মানুষ যেন স্রষ্টাহীন হয়ে দৃষ্টিহীন জীবনযাপন না করে। আল্লাহ্বিমুখ মানুষ যেন আল্লাহ্মুখী হয়ে সৎ জীবনযাপনের মাধ্যমে সুস্থ ও সুন্দর সমাজ স্থাপনে ব্রতী হয়।
Discussion about this post