দেশের ১০টি জেলায় এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাইবান্ধা, চুয়াডাঙ্গা ও চট্টগ্রাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটেছে ঢাকায়, এর পরই মাদারীপুর। আক্রান্তদের মধ্যে নারীর তুলানায় পুরুষ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। তিনি মাদারীপুরের বাসিন্দা। এরপর রোগী শনাক্ত হয় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ রোগটি দেশের ৯ জেলায় বিস্তার ঘটিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় এটি বিদেশ ফেরত ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েক জনের সংক্রমণের উৎস পাওয়া যায়নি। ভাইরাসটি স্থানীয় পর্যায়ে ছড়ালেও তা খুবই কম মাত্রার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাধারণত সংক্রমণের উৎস পাওয়া না গেলে এটিকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলা হয়।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৫ জন করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬১। এ পর্যন্ত আক্রান্তদের ৬ জন মারা গেছেন, ২৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন আর বাকিরা চিকিৎসাধীন।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮ জন পুরুষ এবং ২৩ জন নারী। এখন পর্যন্ত ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন। মাদারীপুর জেলায় ১০ জন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৪ জন, গাইবান্ধা জেলায় ৪ জন। এ ছাড়া গাজীপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা ও রংপুর জেলায় একজন করে করোনার রোগী আছেন।
ঢাকার ৩৬ জন করোনা রোগীর মধ্যে মিরপুরে ৯ জন। এর মধ্যে মনিপুরে ৫ জন, সেনপাড়ায় দুজন, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর এলাকার একজন করে রোগী আছেন। বাসাবোয় ৪ জন, বাংলাবাজারে ৩ জন, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মগবাজার, উত্তরা ও উত্তরখানে দুজন করে রোগী আছেন। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী, আজিমপুর, কলাবাগান, রামপুরা, মহাখালী, বনানী-গুলশান, বারিধারা ও খিলক্ষেত এলাকায় একজন করে রোগী আছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ১৬ জন বিদেশ ফেরত। মূলত তাদের মাধ্যমে দেশে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। বিদেশ ফেরতদের মধ্যে ইতালির ৬ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ৩ জন, সৌদি আরবের দুজন এবং ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, কুয়েত ও বাহরাইনের একজন করে রয়েছেন।
চীনের উহানে ডিসেম্বরের শেষ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে প্রথম ২২ ফেব্রুয়ারি শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয়। শুরু থেকেই এই পরীক্ষার একক ও একমাত্র সেন্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আইইইডসিআর। গত সপ্তাহ থেকে ঢাকায় ৯টি ও বিভিন্ন জেলায় ৫টিসহ ১৪টি কেন্দ্রে এই ভাইরাস পরীক্ষা শুরু হয়। চলতি মাসের মধ্যেই সারাদেশে ২৮টি কেন্দ্রে এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। বেশি বেশি পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সরকার।
আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে এই সময়ে দেশে মানুষের সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয়। আবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণও এগুলো। ফলে সব মিলিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে জ্বর, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্তদের তুলনায় রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এখন অনেক কম। অনেকে হাসপাতালে গিয়ে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন এমন ভয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে গেলেও এসব উপসর্গ শুনলেই চিকিৎসা না দিয়ে বিদায় দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। বিনাচিকিৎসায় কয়েকটি মৃত্যুর খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারও কোথাও কোথাও বন্ধ রয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এ পরিস্থিতিতে এমন লক্ষণ-উপসর্গ থাকা অনেকে ঝুঁকেছেন টেলিমেডিসিনের দিকে। আইইডিসিআর, স^াস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের বিশেষ ফোন নম্বরে কল করে চিকিৎসা নেওয়ার হার বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই সংক্রান্ত তথ্য বলছে, সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে স্বাস্থ্য বাতায়ন নম্বর ১৬২৬৩-এ ফোন করে ৬১ হাজার ৪৪৫ জন, ৩৩৩ নম্বরে এক হাজার ৬৬০ জন, আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে দুই হাজার ৮৭৯ জনসহ মোট ৬৫ হাজার ৯৮৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৬৯ হাজার ৩১০ জন ফোনে চিকিৎসা নেন। এর বাইরেও অনেকে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত কম হলেও এখানে এটি সংক্রমণের দিক থেকে এখন তৃতীয় স্তরে রয়েছে। কারণ মহামারী রোগের কারণে কোনো এলাকা লকডাউন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে সেটি তৃতীয় স্তর হিসেবে গণ্য হয়। এখন দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। করোনা কোন কোন এলাকায় ছড়িয়েছে সেটি জানতে হলে পরীক্ষার হার বাড়াতে হবে। অল্প কিছু টেস্ট করে বসে থাকলে মহাবিপদ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সর্দি, জ্বর, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট এগুলো হচ্ছে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ। যাদের লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু তারা অনেক সময় বুঝতেও পারবেন না তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বুঝতে না পরলেও ঠিকই অন্যদের সংক্রমিত করবেন। এ কারণে যেসব জেলায় করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেসব জেলাকে লকডাউন করা দরকার। এসব জেলার কোনো সংক্রমিত মানুষ যেন অন্য এলাকায় গিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে। যেসব রোগী ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এর পর কোয়ারেন্টিনে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করতে হবে। সংক্রমণ শনাক্তকরণ বিলম্বিত হলে এবং আইসোলেশনে না নিলে সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবে। তখন সেটি নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
Discussion about this post