এমরান মাহমুদ প্রত্যয়,আত্রাই থেকে:
বাংলা মাতৃকার অপরূপ সাজের অন্যতম সঙ্গী হিজল গাছ। হিজল বনের সুসজ্জিত ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় মন ।ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ সবুজ শ্যামল,আর নদী মাঠ ফসলে ভরা,সেই সঙ্গে বর্ষাকালে পানিতে হাবুডুবু। পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদীর জল বর্ষাকালে প্লাবিত হয়ে বিলের সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে নদীর জলবাহিত হিজল গাছের বীজ এসে হিজল গাছের সৃষ্টি । চিরসবুজ এই হিজল গাছ বর্ষাকালে জলে ডুবে থাকলেও সুন্দরী গাছে মতো এরা বেঁচে থাকতে পারে।
সবুজে ঘেরা এই মাতৃভূমিতে
নদী আছে, মাঠ আছে কিন্তু সেই নয়ন মুগ্ধকর রূপসী বাংলার সঙ্গী হিজল গাছ নেই। বর্তমানে তাল, কুল, শিরিষ এই ধরণের কিছু গাছ দেখা যায়। বর্ষা কম হলে কিছু কিছু জমিতে ধান চাষ হয়। বাঁধ ভেঙে আবার মাঝে মাঝে প্লাবিত হয়। জল নামলে রবি শস্যের চাষ হয়।
কিন্তু সৃষ্টি হয় না আর হিজল বৃক্ষের।
বাংলা নাম হিজল, নদীক্রান্ত জলস্ত,কর্ম্মক এবং দীর্ঘপত্রক।
ইংরেজি নাম:Barringionia,Freshwater Mangrove plant,Samundarhsl,Indian Oak,Indian putat.
বৈজ্ঞানিক নাম :Barringtonia acutangula.
ঐতিহ্যবাহী গাছের মধ্যে হিজল গাছ একটি। এ গাছটি আমাদের প্রকৃতি থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আদি নিবাস দক্ষিণ এশিয়া, মালোশিয়া ও অস্ট্রোলিয়া।হিজল মাঝারি আকারের দীর্ঘজীবী চিরহরিৎ গাছ। হিজল গাছ পুকুর, খাল,বিল,নদী-নালা ও জলাশয়ের বেশি জন্মায়।বাকল ঘনছাই রঙের, অমসৃন ও পুরু।ডালপালার বিস্তার চারিদিকে। উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার।
পাতা বড় ডিম্বাকার, ৫-১৫সেমি লম্বা,উপপত্রযুক্ত,চামড়ার মতো মসৃণ।
হিজল ফুল দেখতে খুব সুন্দর। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হিজল গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। সংস্কৃত ভাষায় হিজলকে বলে নিচুল,হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে।১০-১২ সেমি লম্বা পুষ্পদন্ডের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে।গভীর রাতে ফুল ফোটে, সকালে ঝরে যায়। ফুল সাদা, গোলাপি বা লাল রঙের হয়।ছোট, ৬-১০মিমি লম্বা চার পাঁপড়ি বিশিষ্ট। ফুলে এক ধরনের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ আছে। ছোট আকৃতির রক্ত রাঙা হিজল ফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে সৃষ্ট এক দৃষ্টি নন্দন পুষ্প শয্যা।হিজল ফুলের গন্ধে মাতাল কবি নজরুল ইসলাম তাই লিখেছেন, “পিছল পাথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা।কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা…..”
হিজল ফুল শেষ হলে গাছে ফল আসে।ফল তিতা ৩-৪সেমি লম্বা, চার শিরযুক্ত, দেখতে অনেকটা হরীতকীর মতো।ফলের ভিতর একটি করে কালো রঙের বীজ থাকে।ফল মারাত্মক বমনকারক।
হিজল গাছের প্রাণশক্তি প্রবল।বন্যার জল কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকতে পারে। এমন কি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও হিজল গাছ বেঁচে থাকে। হিজল গাছের কাঠ নরম, সাদা বর্ণের উজ্জ্বল মসৃণ ও টেকসই। জলে নষ্ট হয় না বলে নৌযান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।সস্তা আসবাব তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়।এর বাকল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায়।এ ছাড়া উদ্ভিদটির ঔষধী গুরুত্ব রয়েছে।হিজলের বাকল ও ফল বিরেচক এবং ডাইরিয়া ও নাকের ক্ষতে উপকারী। বীজ শিশুদের ঠান্ডা লাগায় ব্যবহার করা যায়।
দেশের আবহাওয়া প্রতিকূলতা, জলবায়ু পরিবর্তন। অকারণে বৃক্ষ নিধন। মাঠে ময়দানে পুকুর খনন,বর্তমানে প্রকৃতির ভারসাম্য উপর প্রভাব পরেছে। মাঠে জন্মানো উদ্ভিদ গাছ পালা বর্তমানে নেই বললেই চলে।দেশে হাজার প্রজাতির বৃক্ষ থাকলেও যুগের আবর্তে বিলিন হয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বৃক্ষ “হিজল……”।
লেখক ও সাংবাদিক
আত্রাই, নওগাঁ
Discussion about this post